শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

সাহিত্য পত্রিকা `সৃজন' বেরিয়েছে

গল্প
আবদুল খালেক ফারুক
একাব্বর আলীর পদ্মপুরান
পদ্মা দিয়াছে আমায় মরণও ফাঁসি/ ঢেউ দিয়োনা কালা প্রাণ শশী/ কি করিবে দেবের পদ্মা/
কোনবা কাজও করে/ গাটা জলে নামিয়া পদ্মা গাটা মাঞ্জন করে/ কালা মায়সেন দিয়াছে আমায় মরণও ফাঁসি...।
একাব্বর আলী ওরফে কারেন্ট কবিরাজ নৃত্য-গীতের দলটির পুরোভাগে। তার পেছনে কয়েকজন সাগরেদ। তাদের সাথে রয়েছে গ্রামের কয়েকজন কিশোরী। একাব্বর আলীর নেতৃত্বে চলছে এক আজব কিসিমের চিকিৎসা পদ্ধতি। চৌকির উপর বসে আছেন রোগী মোহাম্মদ আবদুল করিম। চোখ, মুখ আর গায়ের চামড়া ক্ষানিকটা ঝুলানো।। দেখেই বোঝা যায় বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। চিকিৎসার অংশ হিসেবে এখন তার হাতে পায়ে চলছে তেল মালিশ। একজন গামছা দিয়ে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝাড়া দিচ্ছেন। রোগীকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘুরছে নৃত্য-গীতের দলটি। গানে সঙ্গত করার জন্য একজন ব্যানা বাজাচ্ছেন। তারা গাইছেন মনসার জারী। কিংবা বিষহরা গান। রোগীর হাত পা অবস। কোন শক্তি নেই। কবিরাজ বলেন বাসলি হয়েছে মনসার অভিশাপে। সাপের নি:স্বাশ থেকে এই অসুখ। তাই মনসার জারী দিয়েই ফাঁড়া কাটতে হবে। একাব্বর কবিরাজ চ্যালেঞ্জ দিয়ে চিকিৎসা করেন। বলেন, যেখানে ডাক্তারের শেষ, সেখানেই আমার শুরু। অর্থাৎ ডাক্তার ফেল মারলে ডাক পড়ে কারেন্ট কবিরাজের। তারপর মনসার নামে সাত দিন সাত রাত্রি গীত গেয়ে নামাতে হয় বিষ। কারেন্ট কবিরাজ আওয়াজ দেন, শরীরে ঢুকেছে মনসার বিষ। তাই মনসার কৃপা বিনে এই রোগের চিকিৎসা নেই। অবশ্য তিনি সমঝদার। তাই বোঝেন, শুধু নৃত্য গীতের উপর ভরসা করলে চলে না ; এর সাথে সাপের তেলসহ ৩০ পদের দ্রব্য মিশিয়ে তৈরী হয় মালিশের তেল। দুইয়ে মিলে রোগী ফিট। কারেন্ট কবিরাজ হিট। কবিরাজ চ্যালেঞ্জ নিয়ে চিকিৎসা করেন। পার্টির ভাও বুঝে পারিশ্রমিক নেন। দেড় হাজার থেকে ১৫ হাজার পর্যন্ত পুরো প্যাকেজ। সাগরেদদের পারিশ্রমিক আর কিশোরীদের উপহার বাদে বাকীটা তার। মাসে দুই তিনটি খ্যাপ অনায়াসে মেলে। রোগী অল্প বয়সী হলে সুস্থ হবার ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা। আর বৃদ্ধ হলে নিদেন পে হাটা চলার আশ্বাস দেন। ঝাড়া দিয়েই রোগী একবারে খাঁড়া। কারেন্ট কবিরাজ গেয়ে ওঠেন- মস্তকেতে ছিল বিষ মোর/মঞ্চবে নামিল/ দোহাই ও মা পদ্মার হুংকারে/ বিষ পানি হইয়া গেল।
নৃত্য গীত ক্ষানিক বন্ধ রেখে এক গল্প বলেন সমবেত দর্শক শ্রেতাদের উদ্দেশ্যে। শ্রোতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী । তাতে আরো বেশী জোস অনুভব করেন কারেন্ট কবিরাজ। কারণ এই মনসার গান গাইতে গিয়েই তার সাথে ভাব ভালবাসা হয়েছে দুই রমণীর। ঘটনাচক্রে তারা এখন তার ঘরণী। কবিরাজের বাবরী চুল, আর টানা চোখ এই রমণীদের চিত্ত হরণের জন্য যথেষ্ট। তিনিও রমণীকুলের দিলে চোট দিতে একেবারে রাজী নন। তাই কাজী ডাকতে তার বিলম্ব হয় না।
কবিরাজ বয়ান করেন-একবার হয়েছে কি তখন জৈষ্ঠ্য মাস। এক রোগীর বাসলি ঝাড়া চলছে। পদ্মপুরান গানের সুর, তাল , লয় তখন তুঙ্গে। রোগীরও অবস্থা উন্নতির দিকে। হঠাৎ ফোঁস করে ফণা তুলে সেখানে হাজির হয় এক কেউটে। লম্বা ফণা তুলে দাঁড়ায় রোগীর সামনে। তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে যখন দিব্যি দিলাম মহারাজ তখন ফণা নামিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল বাড়ির পাশের জঙ্গলে। নিজের জারি জুরি জানান দিতে গলদঘর্ম একাব্বর। এক ধরণের রহস্য সৃষ্টির বাহানা আর কি!কবিরাজ আবার গেয়ে ওঠেন-
ও বিষ নামিলরে/ কালিয়া গঙ্গা হারের বিষ মোর নামিলরে/
বিষ ছিল মোর মস্তখানে/ নামল বিষ মোর জবান খানে।
এই জীবনে তিনি কোন কেসে ফেল মারেন নাই। বিষহরা গেয়েই তিনি কাত করেছেন যাবতীয় দুষ্টদের। একথা বলে এক ধরণের বুজুর্কি দেখাতে চান তিনি। হঠাৎ আরো জোসে গেয়ে ওঠেন-
শিব নিল ঢাল তরোয়াল/ চন্ডি নিল ঝাঁটা/
মায়েদের কাইয়া পথ দেখাইয়া/ কালি দেখায় ঘাটা/
চারিপাশে চারি গোমজি মধ্যে খাস গড়ি/ বৌমা জ্বলিয়া ওঠে বল আল্লা নবী।
সমবেত নারীকুলে তখন তন্ময়তা ভর করেছে। কেউ কেউ শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসছেন। একাব্বর আলীও তখন তন্ত্র-মন্ত্র বলে যাচ্ছেন অনর্গল। এসময় ঘটে বিপত্তি। এই সাইকেল আরোহী কিশোর এসেছে নাগেশ্বরীর পোড়াডাঙ্গা গ্রাম থেকে। ছেলেটি কবিরাজের প্রতিবেশী। সে নিয়ে এসেছে এক ভয়ঙ্কর দু:সংবাদ। যার সংপ্তি শিরোনাম হতে পারে‘ সাপের কামড়ে কবিরাজ পুত্রের মৃত্যু’।

আলমগীর কবির বাবলু
সহি রাজাকারনামা
যখন অন্ধকার রাতের নীরব আকাশের বুকচিরে কতগুলো বাদুর পতপত করে উড়ছিল তখন পাঁচ গেরিলাযোদ্ধা সফল অপারেশন শেষে ডেরায় ফেরার চিন্তায় অস্থির, উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। কিন্তু নিশুতি রাতের নিকষ আঁধারে তারা কিছুতেই পথের হদিশ পাচ্ছিল না। এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। কান্তিতে বুজে আসছে চোখ। তবু কাছে-দূরে কোনো লোকালয়ের দেখা মিলছিল না। এই ঘোর দুর্যোগে গেরিলাদল কেবল ধানি জমির সরু আলপথ ধরে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে বেদিশার মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। ঠিক সেসময় পাশের তে থেকে এক যুবক উঠেই ভোঁ-দৌড় দিল। চকিতে গেরিলাদল রাইফেল হাতে সতর্ক-পজিশন নিল। সেকশন কমান্ডার আয়নাল মোলা গর্জে উঠল, `হল্ট।' বোধকরি রাইফেল তাক করার শব্দে ত্রস্ত যুবক তৎণাৎ হাত ওপরে তুলে ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। গেরিলাদল চারদিক থেকে যুবককে ঘিরে ফেলল এবং তার আগপাশতলা খুব ভাল করে নিরীণ করে মোলা জিজ্ঞেস করল, `অ্যাই, কে তুই? এখানে কী করছিলি?'
-আমি করিম। স্কুল শিক্ষক। এখানে পায়খানা করছিলাম। যুবক ভয়ার্তস্বরে জবাব দেয়।
-বাড়িতে ল্যাট্রিন নেই?
-আছে। কিন্তু আজ আত্মীয়ের বাড়িতে এতটাই গুরুপাক খেয়েছিলাম যে, পেটটা ভীষণ মোচড়া-মুচড়ি শুরু করে দিয়েছিল। তাই বাড়ি ফেরার আগে বাধ্য হয়ে ক্ষেতেই প্রাকৃতিক কার্য সারছিলাম।
করিমের বোকা-বোকা উত্তর।
-তা আমাদের দেখে দৌড়াচ্ছিলি ক্যান?
-ভয়ে।
-কীসের ভয়?
-রাইফেলের।
- তুই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে? অকস্মাৎ প্রসঙ্গ পাল্টায় মোলা।
-আমি কোনো পক্ষে নই, আমি বেঁচে থাকার পক্ষে।
-তার মানে তুই সুবিধাবাদীদের পক্ষে। তোর মতো কাওয়ার্ডের বেঁচে থাকাটাই বৃথা, গ্লনিকর। তুই ওপারে যাওয়ার জন্য তৈরি হ। লা-ইলাহা পড়।মোলা মুহূর্তে যুবকের মাথায় রাইফেল ঠেকায়, তাক করে। মৃত্যুভয়ে করিম দরদর করে কাঁপতে থাকে। আর জোরে জোরে `লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা...'পড়তে থাকে। কী মনে হতে আয়নাল মোলা তাক করা রাইফেলটা নামিয়ে নেয়। চোখে কৌতূহল নিয়ে করিমের দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারবি?
-পারব। অবশ্যই পারব।
-যা, এই শর্তে তোকে মাফ করে দিলাম।
করিমের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে আসে। নতুন এক পরমায়ু পেয়ে সে অনেকণ ধরে শ্বাস নেয়। মোলা ফের জিজ্ঞেস করে, এখান থেকে তোর বাড়ি কতদূর?
এই মাইলখানেক।
-আশপাশে কোনো মিলিটারি-ক্যাম্প আছে?
-না, নেই। -
মুক্তিক্যাম্প?
-তিন-চার মাইল দূরে একটা আছে।
-আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবি?
-অবশ্যই পারব।
-তাহলে চল, এবার তোর বাড়ি যাই। একটু খাওয়া-দাওয়া করি, বিশ্রাম নিই। খিদেয়-কান্তিতে চোখ-পেট জ্বলছে; প্রাণবায়ু নিভে আসছে।

খ.
গেরিলাদল করিমের বাড়ি গিয়ে পেটপুরে মুড়ি খেয়ে টুয়েন্টি নাইন খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্দরে রান্নার মৃদু টুংটাং শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকটা বেশ ফাঁকা, নির্জন। বাসা-বাড়ি নেই বললেই চলে। কতণ জানা নেই, গেরিলাদের পেটে তখন খিদেটা চাগিয়ে উঠেছে। মোচড় দিচ্ছে। তারা তৎক্ষণাৎ করিমকে ডাক দেয়। কিন্তু নেই! কোনো সাড়া-শব্দ নেই! সমস্ত বাড়ি যেন ধু ধু প্রান্তর, বিরানভূমি! লোকজন কোন ফাঁকে চম্পট! অজানা শংকায় পেয়ে বসে মোলাকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেড়ার ফাঁক গলে সে দেখে, শত্রু পক্ষ তাদেরকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। আর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের আশ্রয়দাতা-অন্যদাতা করিম। এই নিরাময়হীন নিষ্ঠুর সত্য অবলোকন করে রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে-আক্ষেপে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে মোলার। কিন্তু করার কিছুই নেই। খানিক বাদে করিমের মুখ থেকে হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণের আদেশ ভেসে আসে। অনবরত। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে, চোয়াল শক্ত করে তৎক্ষণাৎ করণীয় ঠিক করে ফেলে মোলা। সহযোদ্ধাদের শেষবারের মতো নির্দেশ দেয়, ঘরের বেড়া ফেলে দেয়ামাত্রই গুলির তুবড়ি ছোটাবে। যদি মরতেই হয়, তবে একের বদলে দুজন করে মেরে তবেই মরব; তবুও হানাদারদের কাছে আত্মসমর্পণ নয় কিছুতেই। আর ঐ নরপিশাচ রাজাকারের বাচ্চাটা যেন বাঁচতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখবে।বলেই আলগোছে ঘরের বেড়ার বাঁধন খুলে ফেলে মোলা এবং সজোরে লাথি মেরে ওটাকে ফেলে দেয়। প্রায় সাথে সাথেই আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে অসংখ্য রাইফেল একযোগে গর্জে ওঠে। যদিও তখনো অন্ধকার কাটেনি, ভোর ফোটেনি।

কবিতা
মিজান খন্দকার
ভ্রমণ
আমিষের জটিল প্রসঙ্গে জড়কুলে লোহাও হারায় তার ধর্ম
জাত-কর্ম। এরূপ স্খলনকালে একই প্রকারে আবার
ছড়িয়ে পড়তেও পারে কোনও বিস্মৃতি? সেই ভয়ে
আত্মপরিচয় বর্ণিত লিপিখানি উত্তরের পান্থনিবাসে
পাঠিয়ে দিয়েও আজ সংশয়ে দোলে কতো মন!
ফলে আজ ছড়ানো-ছিটানো বিগত দিনের সব লৌহভাবাপন্ন প্রাণ
পুনশ্চ সংগ্রহ করি , নিঃসংশয়ে খুলে বলি তাদেরও যতো ভ্রমণ-বৃত্তান্ত।
আদ্যোপান্ত দণি-প্রবণ আরও কতো না দেহ খুলে হৃদচিত্রে
আদ্যবিন্দু খুঁজি আর ধুলোয় সন্ধান করি অবিকল সাঁই।
অথচ ধুলোয় পুষ্প-গড়ন কতো দেহ খুলে কতো সারমর্ম নিয়েছো কেড়ে
বলো তো গোসাঁই? বলো, ধুলোর ধর্ম ভুলেও
কী প্রকার শাস্ত্রমতে আবার গংগাজলেও থাকো ভেসে?
যারা ছিলো ডালে, রৌদ্রগন্ধে ভরা সেই ডানারাও জানে,
এতোটা বয়স হলো তবু বনবাসী এক মেয়ে
একজনও পুরুষ দেখেনি এখনো! আমি তো পথিকমাত্র;
অথচ ঋত্বিকপুত্র ভেবে তপোবনে ডেকে নিয়ে
আমাকেই দেখালো সে পথ। দেখি, সেই পথে
বহুদূরে সূচকরেখার প্রান্তবিন্দুতে জ্বলছে আনন্দঘন সবুজ প্রাণ।
জেনে গেলাম যে, যেতে যেতে অবশেষে ওই পথেই একদিন ভ্রমণও ফুরোবে।

মাইকেল রবিন সরকার
পাশের ফ্ল্যাটে সারারাত একটা ইঁদুর শুয়ে ঘ্যানঘ্যান করে

গায়ের গন্ধ ধুতে রাতের বাসি কাপড়ে
মেয়েটা সরে আসেওদিকে পাপীমন ভাবে অন্য কিছু
অন্য কোনো ঘটনা।

এই ফ্ল্যাটকে আমি আমার
বাড়ি ভাবতে পারি না
কিংবা একটু আগের
স্কুলবালিকাকে প্রেম।

আমার বান্ধবী, কালো-মুখরা মেয়ে
ল্যাম্পপোস্টের ঝিম ধরা আলোয়
সাদা সাদা বাচ্চা খুঁজত।

ওর এই চাওয়ায় আমি
কোনো ভুল দেখি না
মানে দেখতাম না, মানে
আমিও ছিলাম।

এই বৃষ্টিদিনে
আমি আমার প্রথম প্রেমিকাকে হারাই।
অথচ এই ঝড়জলের রাতেও
কোথাও বিয়ে হচ্ছে, কোথাও...

রবীন্দ্রবালিকা
খুব কি মিস কর
আমার সঙ্গ?
চেয়ে দেখ
আমার মুঠোবন্দি হাত
এখনও প্রার্থনারত।

আবু সাঈদ
তোমার জন্য

কখনও কবিতা লিখিনি
তবুও বাসনা তোমার জন্য
কখনও কারও চোখে হারাইনি
এখন চোখে চোখ রাখি
তোমার জন্য
কখনও চোখের কোণে
সৃষ্ট হয়নি-এমন
ঝড় আসে তোমার জন্য
কখনও স্বপ্ন্ও দেখিনি এভাবে
এখন দুচোখ ভরে স্বপ্ন আঁকি
তোমার জন্য
হৃদপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন
শুধু তোমার জন্য...

আব্রাহাম লিংকন
লজ্জা
সমগ্র আফগানের মৃত্তিকা
এখন মলিন, তামাটে।
তোমার হাজার-কোটি ডলারের
চৌকস গোয়েন্দারা
খুঁজে পায়নি লাপাত্তা লাদেনকে!

আলেন্দে থেকে বঙ্গবন্ধু
কখন মৃত্যুবরণ করবে
তুমি তার লগ্ন ঠিকই নির্ধারণ করেছিলে।
কিন্তু পারনি টু-ইন-টাওয়ার
রক্ষা করতে।
তোমার ব্যর্থতার ক্ষোভে
তামা হয়ে গেল কান্দাহার-কাবুল।
তোমার ঔরসজাত তালেবান
তোমাকেই ঘৃণা করে।
তোমার কি লজ্জা হয় না
সাম্রাজ্যবাদ?

জামাল অন্তর
দুরবীন দূরত্বের পাখি
তোমার একগুচ্ছ চুল আর
একুশটি লাল-নীল টিপ
এখনো একটি সময়ের পতাকা ওড়ায়।
ছোট্ট সুন্দর ছায়াদেশ
নিষিদ্ধ নগরী
সাঁকো পেরিয়ে সরু সিঁথির মতো পথ
শহরান্তের ছোট নদী
হাঁটুজল ভেঙে ভেঙে দেখি
তারার রোদ্দুরে পুড়ে গেছে
মৌমাছি দিন; আর
দুর্বৃত্ত রাত্রির অন্ধকার
চেটেপুটে খেয়ে বসে আছে সব
নত্রের শিশির।
তোমার প্রতীতি প্রতিটি চিঠি
এখনো আমার কবিতার চর্যাপদ
মদনমোহনকে
অস্বীকার করে নয়
সত্য-সুন্দর আর জগৎকে চিনেছি আমি
তোমার বিশুদ্ধ ধারাপাতে।
ইচ্ছে ছিল বেগুনের গাছে
ছোট্ট একটা টুনটুনি জীবন,
কর্ণফুলির স্নিগ্ধ জলে স্নান করবে তুমি
টাটিতে শুকোতে দেবে শাড়ি
তোমার একরত্তি মেয়ে
পাঠশালা জীবন তার
আর, তুমি বসে যপ্রহর গুনছ
অথচ আজ কতদিন জানালায় ভয়ঙ্কর রাত
একরাশ লুঠেরা বাতাস
আমাকে ওড়াতে চায়
কল্পনা চাওলার আকাশে
অতঃপর
কী ভেবে উড়িয়ে দিই তোমার
কফি-রঙ ওড়নাটা।

যেখানেই থেক আজ প্রশ্ন করো না
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাক ওটা
তারায় তারায় ছায়াপথে ছায়াপথে
যেখানে সময় তোমাকে আমাকে কখনও বিচ্ছিন্ন করে না।
কিংবা গ্যালিলিওর দুরবীনে ধরা পড়–ক
ঐ অনিকেত ওড়নাটা
বিখ্যাত মিডিয়াগুলো আজ
ফলাও করে ঘোষণা দিক
অচেনা ছায়াপথে এক কিশোরীর
অস্তিত্বের সন্ধান।

তারিফ উল হক
সকালের কবিতা
দোয়েলের ডানায় উড়ে গ্যাছে অন্ধকার
রজনীগন্ধা আকাশ ছেঁয়ে ফেলেছে পৃথিবী
বন্ধ দরোজাগুলো খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে

পেয়ালার মত এক সকাল মানুষের জনপদে
পুনর্জন্মে অথবা আবারও মিথ্যা সুন্দরের পিছু
দিগি¦দিক ধাওয়ায় পিচঢালা রাস্তারা
ধীরে ধীরে একাকার।
এ সকালে কোনো দীর্ঘশ্বাস নেই,
কোনো দুঃস্বপ্নও।

বাদল সাহা শোভন
বৃষ্টি এসেছে মনে
গতকাল রাতে
প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল।
প্রথমে মেঘ তারপর বজ্র
অতঃপর বর্ষণ।

প্রবল বর্ষণে
ভিজে গিয়েছিল
বকুল গাছটা
ঘরের চাল
ডায়ানথাস ফুলগুলো
মসৃণ উঠোন...
তারপর বৃষ্টি থেমে গেল,
সবকিছু নিশ্চুপ।
মধ্যরাতে আবারও
মেঘ, মনের উঠোনে
তারপর বজ্র
সবশেষে বৃষ্টি।
ভিজে গেল তোষক, বালিশ
ভিজল লেপ-কাঁথা
আর নেত্রযুগল নোনা পানিতে।

সুর্যের প্রখর রশ্মিতে সবকিছুই
শুষ্ক হয়ে উঠল
শুধুমাত্র চোখের গহ্বর থেকে
সৃষ্ট হলো নায়াগ্রা।

অনন্যা গোস্বামী
আয়নায় দেখি তাকিয়ে
সে বড় ক্লান্ত থাকে আজকাল।
খুব নিস্পৃহ, অবসন্ন!চোখদুটো তার ভীষণ খোলা।
বুজে আসে অজান্তেই-আনমনে!
সে বড় একলা থাকে আজকাল।
সহায়, নিঃস্ব যেন!
নিতান্ত অবুঝের মতো দৃষ্টি তার।
হারিয়ে যায় দূরে কোথাও-ইচ্ছাকৃত।
সে বড় অস্থির থাকে আজকাল।
অশান্ত; কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল!
চুলগুলো তার উশকো-খুশকো।
কপালের ওপর এলিয়ে পড়ে আলতোভাবে!
সে বড় অসুস্থ থাকে আজকাল।
অসাড়, দুর্বল, অত্যন্ত ঠুনকো!
দেহখানা তার প্রচণ্ড নড়বড়ে।
ভেঙে পড়ে যায়-ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন!
সে বড় লুকিয়ে থাকে আজকাল।
অদৃশ্য, অস্পষ্ট, আবছা!
উপস্থিতি তার কেমন যেন
বোধহয় মুছে যাচ্ছেস্বতঃস্ফূর্তভাবে!
সে বড় শূন্য থাকে আজকাল।
ঝাপসা; কতকটা অনিশ্চিত!
অস্তিত্ব তার ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে
সত্তাহীনতার কাল গহ্বরে।
নিরুপায় হয়ে!

জাকিউল ইসলাম ফারুকী
স্বপ্নের মতো
স্বপ্নের মতো প্রিয় নারী চাই
পাইনি।
কখনো সহসা অধীর হয়েছি
প্রেমের ফসলে চপল থেকেছি
চোখের তৃষাতে ব্যাকুল নয়নে
তোমাকে দেখতে চাইনি
স্বপ্নের মতো প্রিয় নারী চাই
পাইনি।
তুমি চলে গেলেমনে হতো সব মিথ্যে
তুমি ফিরে এলে
গল্পের ছায়া ভরে যেত নানা তথ্যে
কাহিনী কখনো সত্যের মতো হয়নি
স্বপ্নের মতো প্রিয় নারী চাই
পাইনি।
ভোলাতে চেয়েছ
অশ্রুর বাণী দিয়ে
আমি তো তোমার শত জনমের
প্রেমের সত্য নিয়ে
চিনেছি আকাশের ধ্রুবতারাসম জ্যোতিতোমাকে
জেনেছি আমারই সম্মতি
তবুও কখনো অস্থির হয়ে
তোমারই পিছু ধাইনি,
স্বপ্নের মতো প্রিয় নারী চাই
পাইনি।

ফেরদৌসী রহমান বিউটি
খুঁজে ফিরি
(রবীন্দ্রনাথকে)

বাংলার ভাগ্যাকাশে তুমি জন্ম নেবে বলে হয়তো
বাংলার আকাশ এত সুনীল
প্রকৃতি এত শ্যামল।
তোমার লেখনির মহিরুহ শক্তি
বাঙালির চেতনায় অঙ্কুরিত হয়েছিল,
স্বাধীনতার বীজ।
লব্ধ করেছি মোরা
ভাব, ভাষা ও মাকে

তোমার হৈমন্তীরা আজও নিপীড়িত
যৌতুকের দায়ে হচ্ছে বলিদান
নাড়া দেয় সুপ্ত অবচেতন মনকে
তোমাকে খুঁজে ফিরি মোদের সত্তায়।

ইউসুফ আলমগীর
ভূমিপুত্র
কি কথা কও ভূমিপুত্র ভাওয়াইয়ার সুরে
সুর আর স্বরে এতো ভাব-ভাবনা
ভবের আবেশে আজ শুধু কামণা
কামুক সিক্ততায় আটকাও জীবনের চরে
জেগে ওঠা চরে
লাগে বসতের ঢেউ
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসে
স্বপ্নের শুভ্রতা...

সোলায়মান বাবুল
বসতি
বারান্দাটা;
খোলা আকাশে প্রান্তহীন গাঢ় নীলে
মুক্ত হেঁটে বেড়াচ্ছি।
শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো খেলতে থাকে;
কোত্থেকে কতগুলো হলুদ, কতগুলো বেগুনি, কতগুলো কমলা রঙের
ছেঁড়া মেঘ নিয়ে আসে! নিয়ে আসে অজস্র তারকারাজি
নিয়ে আসে ভাসমান শিলাখণ্ড কিছু!
প্রতিটি শিলাখণ্ডে অঙ্কিত আমারই পদচ্ছাপ,
প্রতিটি তারকা পুঞ্জে আমাতেই জ্যোৎস্না
আর ছেঁড়া সেসব মেঘের দোলাচল বেশ!

শোবার ঘরটা;
পঁচিশে মার্চ একাত্তরের রাত দশটায়
অজস্র ঝাঁঝালো মর্টার, মেশিনগান যখন
ঘুমন্ত রাত্রির বুক ভেদ করে আমাদের শয়ান খুঁজে বেড়ায়;
মাতৃরূপ স্নেহ-বাৎসল্য কী অপার মহিমায় বুকে আগলে রাখে
বলে, বৎস শান্ত হও।
এঘর ওঘর সেঘর;ছ'টি প্রাণ হাত ধরাধরি করে
এক প্রাণের একটি ছায়া রচনা করে
সে ছায়া একহারা গড়নের পিতৃরূপ একটি আশ্রয় গড়ে তোলে
পিতা তার প্রসারিত দু'বাহুতে আমাদের ঘুম-জাগরণ
আর বয়সের দুর্বহ ভার বয়ে বেড়ান অবলীলায়।
আর ছোট ছোট গল্প শোনান রাজকুমার রাজকন্যার!

ডেভেলপার;
স্মৃতিচিহ্নগুলো যেখানে মূল্যহীন
যেখানে মুদ্রাযন্ত্রের দীাগ্রহণ মুখ্যতর
জীবন দ্রুত যন্ত্রমান হবার প্রতিযোগিতা
কী ছিল কোথায়? কী দরকার সে জ্ঞানে?
এমত প্রশ্নবাক্যে হৈ হৈ রৈ রৈ
আর হাতুড়ি, শাবল ধুমাধুম
হা, বসতি আমার!

নাসির যোয়াদ
ঝাউদিঘি
জীবনের মূলরেখায় যেতে চেয়ে
অবশেষে জানলাম
চেষ্টা শব্দটার সৃষ্টি ব্যর্থতায়।
জীবনের বেশিটা সময় কেন হতাশায়?
জানলাম,
তুমি মূলরেখার দুঃখ দিয়ে গঠিত।
নিরাকারের রূপ দেখার ইচ্ছে
আকার হওয়ায় কেন উধাও?
জানতে পারলাম, আকার দ্বারাই
নিরাকার গঠিত হয়।
দিনরাতের মুখাপেক্ষিতায়কোনটি মহান?
বোঝা গেল, আমি দাঁড়িয়ে আছি দিনে
কিন্তু এখনো রাত।
জীবনের অন্ত-আদি খুঁজি
দেখি, সব কালই বর্তমান
আমি নিস্তব্ধ

বই আলোচনা
মাহফুজুল ইসলাম শামীম
যুদ্ধার্থীগণ পুনশ্চতেও কাতরায়
প্রধানত কবি তিনি। কাব্যের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করতে করতে ছোটগল্পের ডিঙি নৌকোয় পা দিলেন মিজান খন্দকার (১৯৬০-)।আশা তাঁর-`পুনশ্চ যুদ্ধার্থী'গণ নামবে যুদ্ধে, স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে নিয়ে গড়বে নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু `দখল' থেকে মুক্তি না পেয়ে তারা কি `ডানা' মেলে ছুটেছে শূন্যতার পানে? গ্রন্থিত চারটি গল্পে এ সত্যই তো ধাবমান।
নদী, নারী কিংবা প্রযুক্তি দখলের বয়ান...সভ্যতার সাথে নদীর প্রবহমানতা সর্বজনস্বীকৃত। নদীর নিজস্ব অন্তর্ময় ভাষাকে বিদীর্ণ করেছে সভ্যতার অনিবার্য অনুষঙ্গ প্রযুক্তি। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ শুধু জলের চরিত্র নয়, জলজীবনকে দাঁড় করিয়েছে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। সুবোধ ঘোষের অযান্ত্রিক বিমল যন্ত্রের সাথে সখ্যতা গড়লেও মিজান খন্দকারের নুরুল যন্ত্রসখা হতে পারে নি। পারেনি বলেই বদরুদ্দিনের হাতে তাকে হতে হয়েছে নির্যাতিত, নিগৃহীত। কিন্তু প্রাযুক্তিক-পুঁজি জন্ম দিয়েছে যে ঘাটিয়ালের তারা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারে নি। পরিবর্তনে সায় দিতে না পারায় অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত নুরুলের চৈতন্যপ্রবাহে এক অনাম্নী নারীদেহের আগমন ঘটেছে সত্য, তবে খোতের সঙ্গে চাঁদের আলোয় বিক্ষোভমিশ্রিত মিলনই হয়েছে তার পরিণতি। সম্মত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সূত্র ধরেই পুরুষ নারীর ওপর সমাধিকার স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছে। নদী আর নারীর দ্বৈরথে বিভক্ত হয়েছে নুরুলের সামূহিক চেতনা। `দখল' গল্পের শুরুতেই তাই চেতন-অবচেতনের অবিরাম প্রবাহে বিনষ্ট হয়েছে নুরুলের ঐতিহ্যিক অভিজ্ঞান। গল্পকারও কোনো প্রতীকী পরিচর্যায় না গিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছেন কার্যকারণ। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ধরলা তীরের জীবনবাস্তবতার এ এক অনুপম আলেখ্য- `বউকে মনে পড়ে তখন, গ্রামে যখন তার বাড়িভিটা সব ছিলো, স্বচ্ছল সংসার ছিল, তখন খোতের শরীরও যৌবন-লাবণ্যে নদীর মতোই এমন ঝলমল করে জ্বলতো, ঝলসাতো। একটা দীর্ঘশ্বাস তার কলজেটাকে ধারালো ছুরির মতো ফালা ফালা করে কেটে কেরিয়ে আসে বুক থেকে।' [দখল]
কাক, পাখি আর স্বাধীনতার প্রতিবর্গীকরণ...`মানচিত্র মানে একটা দেশ, একটি পতাকা, কিছু মানুষ এবং স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতা হলো বৃরে মতো, একটু একটু করে ফলবতী হয়ে ওঠে।'... না, আটত্রিশ বছরেও আমাদের শিশু স্বাধীনতা-চারাগাছটি বৃক্ষ হয়ে ওঠে নি, ফলবতী হওয়া তো সুদূরপরাহত আকঙ্ক্ষা। চার দশকের দৃশ্যমান বাস্তবতা এখন রূপ নিয়েছে ভয়ঙ্কর মূর্তিতে। রাষ্ট্রকাঠামোর এমন কোনো গলি নেই আজ যেখানে জন্ম নেয় নি পঁচা দুর্গন্ধময় ডাস্টবিন। সে ডাস্টবিনগুলোর নীরব দর্শক একটি বা একগুচ্ছ কাক। তিনটি পরিচ্ছদে ভাগ করে পঁয়ত্রিশটি বিচ্ছিন্ন দৃশ্যাবলীর এক কোলাজ ক্যানভাস তৈরি করেছেন মিজান খন্দকার তাঁর `পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ' গল্পে। গল্পে বর্ণিত প্রতিটি দৃশ্যপটই সাদা চোখে দেখবার মতো কিন্তু অন্তর্কাঠামোর বাস্তবতা উপস্থাপিত হয় নি। কাকের চোখ দিয়ে দেখে তাতে জল জমে নি গল্পকারের। এ নির্বাক নির্মোহ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে মুগ্ধ করে তবে আর্থকাঠামোর স্বরূপ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটলে পাঠক নিজেই হয়ত হতো এক একজন যুদ্ধার্থী। কেননা, দর্শক-পক্ষীকুল তো `সম্ভ্রম-বিজরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পুনশ্চ উদ্ভব হওয়া যুদ্ধার্থীগণের দিকে'ই।
জীবন যাত্রার খণ্ডচিত্র...কোচটির নাম জীবন এক্সপ্রেস। কুড়িগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু, গন্তব্য ঢাকা। ড্রাইভার কন্ডাক্টরসহ মানুষ ৩৮ জন। গল্পটির মোট চরিত্র ১৮। বাকি ২০ জনের নাম-পরিচয়-পেশা অনুল্লিখিত। কুড়িজন আরোহীর পঞ্চাশটি ভিন্ন ঘটনা প্রবাহ ও আলাপচারিতার গল্পিক ভাষ্য `একটি দূরপাল্লার কোচ ও গতির অভ্যন্তরে কিছু বহুভেদক প্রাণ'। গল্পকার গল্পটি সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। বয়ানের ভাষায় কাব্যময়তা স্পষ্ট। একদিকে গর্ভবতী নারীর বাচ্চা প্রসব জীবনের ইঙ্গিতবাহী আবার পরিণতিতে মৃত্যু যেমন গাল্পিক দ্বন্দ্ব (পড়হঃৎধংঃ) তৈরি করেছে তেমনি গল্পকারের ভাববাদী দর্শনেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতি-জীবন-প্রজন্ম দ্বন্দ্ব-মফিজ চেতনার দ্বিমুখী ব্যাখ্যায়ন-পেশাভাবনা-অর্থনীতি-সমাজচেতনা-ফ্যাশনাবেশ-জৈবিক প্রবৃত্তির সামষ্টিক দর্পণ হয়ে আছে গল্পটি। পেশার সঙ্গে ভাষার বহুমুখীনতা গল্পটির প্রাণ। নিরীক্ষাপ্রবণ গল্পের প্রথাগত পরিসমাপ্তি গল্পটির শিল্পসৌন্দর্য্য ক্ষুন্ন করলেও সর্বজ্ঞ লেখকের ঘটনা পরিবীক্ষণের স্থান ও কাল পাঠককে প্রশ্নের মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে।
সাবিত্রী আর জোবেদার আর্তচিৎকার...বীভৎস সমাজের পাশবিক হিংস্রতার হাত থেকে রক্ষা পায় নি তাঁরা। `ওমার নাম আল্দা, ধর্ম আলদা, কিন্তুক ওমরা জাতে এক। ওমরা রাখাল হয়া সাবিত্রীকে পোড়ায় মারে, সোবহান হয়া জোবেদার শরীলে আগুন ধরে দিয়া মারি ফ্যালে। ওমার আলাদা কোনো জাত নাই।'এই বেজাতি পুরুষতন্ত্র, ধান্ধাবাজ নারীবাদী, পঙ্গু সংবাদপত্র (মিডিয়া?), নোংরা সমাজপতি, অশ্লীল আইন, জঘন্য রাষ্ট্র, পকেটভারি এনজিও, আখের গোছানো স্বেচ্ছাসেবী, কিংবা বিকৃত মুক্তনারী... কেউই থামাতে পারে নি সাবিত্রী আর জোবেদার আর্তচিৎকার। পুড়েছে, মরেছে তবু পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছে ক্ষতস্থানগুলো। কোনো সংঘ-সমিতি-আইন তাদের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে নি; এ যেন আঠারো শতকীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষ। গল্পকার দেখেছেন এবং লিখেছেন সেভাবেই। গল্প নয়, স্মৃতিদৃশ্যপট উন্মোচন করেছে সত্য ঘটনার এবং সমাজব্যবস্থার প্রতিই একটা বিবমিষা জাগিয়ে তুলেছে পাঠকের। দৃশ্যপট যখন আমাদেরই সমাজের একটা করুণ নোংরা ঘা-য়ের তখন শৈল্পিক গঠন হয়ে পড়ে গৌণ। তবে প্রতিবাদ নেই কেন কোথাও? তবে কি এ সমাজ নির্লিঙ্গদের আস্তাবল? হতে পারে। যে কারণে গল্পকার বলেন- `তথাপি এ কাহিনী শেষ হয় না' এবং একথাও সত্য বলে প্রতীতী জন্মায় যে-`রৈখিক ধ্বনির সব চিৎকার মৃত্যুর মতোই...'। তবে আসুন মিজান খন্দকার-এ সমাজটাকেই ছুঁড়ি ফেলি। জল আর কাদামাটির নতুন প্রতিমা দিয়ে গড়ে তুলি এক মানবিক কাব্যময় সমাজ।

সৃজন বর্ষ ১৭ সংখ্যা-১সেপ্টেম্বর ২০০৯
এ সংখ্যার সম্পাদক
ইউসুফ আলমগীর
মাইকেল রবিন সরকার

সম্পাদনা পরিষদ
আব্দুল খালেক ফারুক
আহসান হাবীব নীলু
ইউসুফ আলমগীর
মাহফুজুল ইসলাম শামীম
মাইকেল রবিন সরকার

1 টি মন্তব্য:

  1. ভালো লেখার সমাহার। মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলে আনন্দ বোধ করতাম।

    লেখাগুলো পড়লাম। উন্নতমানের লেখাগুলো দেখে খুশি হলাম। মফস্বল শহর থেকেও এমন লেখা বের হয়ে আসে দেখে উৎসাহিত হচ্ছি।

    নিয়মিত নিত্য নতুন লেখা প্রকাশ করুন এই কামনা করি।

    ধন্যবাদ

    aR
    Bangla Hacks

    উত্তরমুছুন