বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১১

আটজন স্বপ্নভূক কবির কবিতা নিয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়াধর্মী কথাবার্তা / সাম্য রাইয়ান

বোধ করি, কবিদের েেত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, তাঁরা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পান। শুকনো পাতা ভেঙে চুরমার হচ্ছে -এর শব্দ শুধুমাত্র কবির পইে শোনা সম্ভব। এর ফলে স্বাভাবিক কারণেই কবির সাথে পার্থক্য তৈরি হয় সাধারণ মানুষের।

পেটো কথিত ‘আদর্শ রাষ্ট্রে’ কবিদের বাস
নিষিদ্ধ হয়েছে বহু আগেই;
যদিও সেই ‘আদর্শ রাষ্ট্রে’ কবিরা বাস করতে আদৌ ইচ্ছুক কি না তা প্রশ্নসাপে ব্যাপার

যে কবি রাজনীতি বোঝেন না, তার কবিতা শেষপর্যন্ত আমি-তুমি মার্কা হালকা প্রেম-ভালোবাসার স্তরেই থেকে যাবে। সমাজ-রাষ্ট্র তার অধরাই থেকে যাবে। এধরনের চর্চা বাঙলাদেশে প্রচুর হয়েছেÑ এখনও হচ্ছে। আবার অনেক কবি সুযোগসন্ধানী আচরণ করছেন; বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের গোলামী করছেন। (যদিও তাদের ‘কবি’ বলা উচিত কি না তা প্রশ্নসাপে ব্যাপার)। যেহেতু সমাজ দূষিত হলে শিশুর দুধের ওপরও তার প্রভাব পড়ে, তাই কবিতা নিয়ে এরকম ধান্দাবাজির প্রভাব কুড়িগ্রামেও পড়েছে, যা এখনও কারো কারো চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কেউ বুর্জোয়া গণ(?)মাধ্যমে নায়িকার দু’পায়ের ফাঁকে এক-আধখানা চরণ ছাপিয়ে নিজেকে কুড়িগ্রামের প্রধান কবি ভাবতে শুরু করেন, আবার কেউ ‘টিকে থাকার জন্য’ মতাসীন দলের আব্বা-স্বামী-চাচা-ভাই-মামা অমুক-তমুকের নামে সাহিত্য-সংস্কৃতির দোকান খুলে বসেন। কিন্তু আনন্দের বিষয় এই যে, এইসব ধান্দাবাজির বাইরেও অনেকে কবিতা চর্চা করছেন; নিজের কাব্যজগত নির্মাণে মগ্ন রয়েছেন। মূলত তাঁদের কয়েকজনের প্রতি নজর দেয়াই এই পাঠপ্রতিক্রিয়াধর্মী লেখার মূল উদ্দেশ্য। (আরো কঠোর হলে হয়ত’ এখান থেকেও কিছু নাম বাদ যেত!) পাঠক, চলুন শুরু করা যাক.....

তারিফ উল হক শুভ্র সরখেল রাশেদুন্নবী সবুজ নুরে আলম দুর্জয় জ্যোতি আহমদ মাইকেল রবিন সরকার ইউসুফ আলমগীর হেলাল জাহাঙ্গীর

নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর এক তরুণ কবি তারিফ উল হক। ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়াই তাঁর অধিকাংশ কবিতার বিষয়বস্তু। কবিতায় মার্কসবাদী চিন্তার ছাপ পাওয়া যায়। মুক্তির চেতনা প্রায় কবিতাতেই স্পষ্ট।

আজীবন নমস্য মিথ্যাকে মৃত্যুর আগে একবার লাথি মারা / আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা। / অন্যভাবে যদি বলি / সাত জন্মের পাপের সাী হৃদয় শিরা-উপশিরা। / বেঁচে থাকার জন্য আজি বেঁচে দিয়েছি সব, / গরিবের ঈশ্বরও গরিব / তাই চাওয়াগুলো ভীষণ ুদ্রতায় / ঠিক চাওয়া হয়ে ওঠে না।
(তারিফ উল হক \ স্মীকারোক্তি \ প্রচ্ছদ সাহিত্যপত্র-২ \ বৈশাখ ১৪১৬ ব.)

বি ডি আর বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে কবিতায় তুলে আনার কাজও তিনি করেছেন-

আমাদের যখন নির্যাতন করা হতো / আমাদের শ্রমের টাকা লুট করে নিয়ে ফুর্তি করতো ওরা দিনরাত / তখন কোনো আইন ছিলো না / তখন কোনা নৈতিকতা ছিলো না / তখন কোনো মানবতাও ছিলো না / যাদের শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু / আমাদের শোষণের ফল / তাদের আমরা মৃত্যুদন্ড দিয়েছি। / আমরা জানি- / আমাদের গরীবদের বিরুদ্ধেই / ওদের সকল আইন-নীতি আর / টিভি-মিডিয়ার / নোংরা মিথ্যাচার; / আমি জানি আমার পরিণতি কি / তবু লড়াইয়ের ডাক দিয়েছি। / আমাদের মরতে হবে মুক্তির জন্য / আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গ্যাছে।
(তারিফ উল হক \ ডি এ ডি তৌহিদের কথা \ শ্বেতপত্র-১)

এেেত্র আরেক তরুণ কবি শুভ্র সরখেল -এর অবস্থানও একই। যার ফলে তিনি বলেন,

জাহানারা ইমামের আন্দোলন / আর বি ডি আর সংগ্রামের পার্থক্য তো / দেখি না!
(শুভ্র সরখেল \ প্রশান্তির গালিচায় আমার কবিতা এঁকে দিও \ শ্বেতপত্র-৪ \ অক্টোবর ২০০৯ খ্রি.)

শুভ্র সরখেলের কবিতার প্রতি অনুতে ইতিহাস চেতনা থাকে সক্রিয়। গ্রিক মিথোলজির ব্যবহার কবিতায় ভিন্নমাত্র যোগ করে। তাঁর কবিতা নিরন্তর হাতুড়ির শব্দ। ...প্রতিশিল্পের জগত নির্মাণ করে চলেছেন ক্রমাগত, নিভৃতে।

আমার মানুষ হবার দীর্ঘ পথ জমা রেখে দেই / বসুন্ধরার কোলে। শেষমেষ মানুষ হবার / পুণঃপ্রচেষ্টা। / আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি কার্ল মার্কসের অঙ্কগুলো কষে।
(শুভ্র সরখেল \ বাল্যকালের বায়োস্কোপ \ বিন্দু-১০ \ শ্রাবণ ১৪১৬ ব.)


রাশেদুন্নবী সবুজ -এর কবিতা তাঁর যাপনের সাথে একাতœ হয়। জীবনের প্রাত্যহিক কথামালাই তাঁর কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর ‘লেখার ভাষা’ খুঁজে পেয়েছেন, যা খুব কম লেখকের পইে সম্ভব হয়। কখনো তিনি কবিতায় এমন কিছু দৃশ্য আমাদের দেখিয়ে দেন, যা আমরা সাধারণভাবে ল্যই করিনা! তিনি আমাদেরকে দেখিয়ে দেন, ‘কাঁদতে-কাঁদতে লাল হয়ে যাচ্ছে মাটি ও পিচ ঢালা খয়েরি সড়ক’।

আলো থেকে অন্ধকার পর্যন্ত কারফিউ / বেতারের প্রচারিত হচ্ছে সাধারণ জনপদের ঘটনা / আর শকুন আর কুকুর আর শেয়াল খেতে খেতে বমি করছে / গত দু’দিন বাইরে পা বাড়ানো যাচ্ছে না / হিমালয় শৃঙ্গে বাতাসের শো শো শব্দ শোনা যায় / ভয়ানক ঝড়ের সাথে বুলেট বৃষ্টি হচ্ছে পূর্বাভাস ভেঙে / হঠাৎ আতঙ্কিত বেড়াল গলায় কাঁটা বিঁধে কাঁশছে / মেঘের আঙিনায় ভয়, বাতাসথজোৎস্নাথজল কাঁপছে / কাঁটা তারের বেড়ার ওপাশে অপহৃত সূর্য আটকে আছে অপেক্ষায় / কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে যাচ্ছে মাটি ও পিচ ঢালা খয়েরি সড়ক / নিখর্ব জোড়াজুড়ির পরও চোখ দেয় নাই এক ফোঁটা জল / শুধু তাকিয়ে ছিল পঁচা গলা নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখের ভালোবাসা /
(রাশেদুন্নবী সবুজ \ ওরা বিশ্ব মাতুব্বরের কা-কা শব্দ শুনেছিল \ বিন্দু-১১ \ বৈশাখ ১৪১৮ ব.)

‘শামুকের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সমুদ্রের ফেনা’ দেখতে পাওয়া এক তরুণ কবি নুরে আলম দুর্জয়। রাশেদুন্নবী সবুজের মতো তাঁর কবিতায়ও সু কিছু ব্যাপার অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে আসে-

শামুকের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সমুদ্রের ফেনা / তোমাকে খুঁজবে না আর কখনো / একদিন হয়তো শামুক কুড়াতে গিয়ে দেখবে / সমুদ্র থেকে বিতাড়িত সেই লেপ্টে থাকা ফেনা
(নুরে আলম দুর্জয় \ অবশেষের শেষ \ বিন্দু-১১ \ বৈশাখ ১৪১৮ ব.)

এই কবিই আমাদের অবাক করে দিয়ে বলেন,

নগরের রাস্তায় জমাটবাঁধা জলে / নিজেকে দেখে নেই আর একবার / ... / বাড়ি ফেরা উৎসবে ফেরার বদলে হাঁটতে থাকি / আমি নই শুধু / শহুরে কুকুর কাক টোকাই / আর আছে অদ্ভুত কিছু নিঃসঙ্গতা
(নুরে আলম দুর্জয় \ শহরচিত্র \ শ্বেতপত্র-৪ \ অক্টোবর ২০০৯ খ্রি.)

ব্যক্তি সর্বদাই মূখ্য হয়ে ওঠে ইউসুফ আলমগীর এর কবিতায়। আরো স্পষ্ট করে বললে, ব্যক্তির সংকট, নাগরিক টানাপোড়েন, মানসিক বিকৃতি এসবই তার কবিতার মূল স্বর। আমরা যে ধীরে ধীরে শেকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, অন্তরের বন্ধুকে ‘ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড’ বানিয়ে ফেলছি, এইসব বিষয় তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে বারবার।

আমার মুখরতা-আমাদের মুখরতা / এখন জারুল আর তমালের নয় / দিগন্তজোড়া ইউক্যালিপ্টাসের সরু পাতায়... / ... / আমাকে শুষে নেয় কর্পোরেট বৃ... / ... / পাখিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে / হায়! কিসের আয়োজন / কিসের চাষাবাদ...
(ইউসুফ আলমগীর \ আমাদের মুখরতা \ কথন ১ \ মে ২০১০ খ্রি.)

অথবা-

মুঠোফোন সঃস্কৃতিতে চিঠি আর লেখা হয় না / চিঠির বার্তা ভাসে যন্ত্রের মনিটরে / ... / কন্ট্যাক্ট লেন্সে বদলায় চোখেরও রঙ / ক্রিমের পলেস্তার ত্বকে দুপুর গড়িয়ে যায় / ফেশিয়ালের দোকানে ভিড় করে হাজার তরুণী / হায়! তুমি বুঝি সখা এখনো / সেই মুঠোসাবান আর সোডায়...
(ইউসুফ আলমগীর \ কিছু মেঘ ছায়ার শরীর \ ফেব্র“য়ারী ২০১০ খ্রি.)

পুরোদস্তুব বিপবী ঘরানার কবি হেলাল জাহাঙ্গীর। মোট দু’টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; জ্বলে প্রেম! জ্বলে আজন্ম বিপব!! (২০০২খ্রি:), আলোর উপরে আলো!! (২০০৫ খ্রি:)। শুরু থেকেই তার কবিতায় বিপবের আকাঙ্খা, অনুন্নত পুঁজিবাদী এই সমাজ ভেঙে বৈষম্যহীন নতুন সমাজ গড়ার আহ্বান স্পষ্ট। প্রায় অধিকাংশ কবিতাই অরবৃত্তে রচিত।

জাগো শোষিত-নির্যাতিত / সর্বহারার দল / রক্ত আলোয় জেগে ওঠো / সাম্য যুদ্ধে চল্। / ... / এসমাজ যে বুর্জোয়াদের / পুজিবাদের গড়া, / গণতন্ত্র-স্বাধীনতার / স্বাদ লোটে তাই ওরা। / ... / আমরা মরি অকালে হে / বানে-খরায়-শীতে / আমরা মরি মিছিলে হে / রাজপথে-মঙ্গাতে। / ... / সাম্য আলোয় গড়তে হবে / প্রিয় বাংলাদেশ / সকলে রবে সমঅধিকারে / বঞ্চনা হবে শেষ।
(হেলাল জাহাঙ্গীর \ সাম্য আলোয় \ প্রচ্ছদ-১ \ মার্চ ২০০৮)

রাজনৈতিক বিষয়-আশয় নিয়ে কবিতা লেখায় অসাধারণ দ কবি মাইকেল রবিন সরকার। তাঁর আজ রাশিয়ায় বৃষ্টি হচ্ছে না, অমিয়বালার প্রতœতত্ত্ব, শোক দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যতোটা শোনা যায় -কবিতাগুলি বাঙলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আন্তর্জাতিক বিষয়কে কতোটা চমৎকারভাবে কবিতায় নিয়ে আসা যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন। যদিও তার সা¤প্রতিক কবিতাগুলি সেই তুলনায় কোন গুরুত্বই বহন করে না।

রবার্ট, আপনি জানেন / পৃথ্বীখ্যাত রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের সাথে / সি আই এ’র সম্পৃক্ততার কথা- / ফ্যামিলি জুয়েলস্ এর অদ্যোপান্ত। / তাদেরই পোষক রাষ্ট্র আমেরিকা আজ / গণতন্ত্রের মহান তান্ত্রিক সেজে কেবলই / গণঔম্ গণঔম্ করছে। / ... / রবার্ট, আপনার জানার কথা / শোষিতের শ্বাসকষ্ট চরমে পৌঁছলে / এক একটা ফিলিস্তিন হয়। / ুধার প্রতিটি স্তর তখন ভরে ওঠে অফুরন্ত শস্যে / হারানো ভূখন্ড ফিরে পেতে সদ্যজাত শিশুরা / কোন এক আবাহনী মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে / যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব সারে।
(মাইকেল রবিন সরকার \ শোক দীর্ঘায়িত হচ্ছে \ উত্তরের জানালা-৩ \ আগষ্ট ২০০৭ খ্রি.)

বাঙলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি জ্যোতি আহমদ। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই বেশ দীর্ঘ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, কবিতায় তিনি এতো চমৎকারভাবে দৃশ্যকে শব্দবন্দী করেন, পড়ার সাথে সাথে পাঠকের সামনে দৃশ্য ভাসতে থাকে। তার কবিতা পড়তে পড়তে কখনোই বিরক্তি বোধ হয় না, বরং একটি লাইন পরের লাইনে যেতে উৎসাহ জোগায়। প্রায় প্রতিটি কবিতায় তিনি নিজের জগত নির্মাণ করেন। ঠিক সেরকমই দুর্দান্ত কবিতা হল, রূপনগর, আমাদের মনের কোন মঙ্গা নেই, পরশ্রীকাতর কবির দিনলিপি (সিরিজ), আত্মহত্যার মেয়েটির দ্বিধা ছিল প্রভৃতি।

কবিতার েেত্র ভাষা কখনও মূখ্য বিষয় নয়। শুধুমাত্র ভাষার জোড়ে কবিতা টিকে থাকে না। বিশ্ব কবিতা ইতিহাসে তারাই টিকে ছিলেন, যাদের নিজস্ব কাব্যজগত ছিল। এই গদ্যে উলেখিত আটজন কবিই নিজেদের কাব্যজগৎ নির্মাণে সক্রিয়। সামনে অনেক পথ; ব্যক্তিগত বোঝাপড়া (পড়াশুনা+অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে), পরিবেশ-পরিস্থিতি আর্থসামাজিক প্রোপটই ঠিক করে দেবে- এঁরা কোন পথে যাবে।

ভিন্নরুপী / জুলকার নাইন স্বপন

শীতের সকাল। সবুজ ঘাসের বুকে রসে টইটুম্বুর শিশির বিন্দুগুলো মুক্ত দানার মতো চিক চিক করছে। আজ কুয়াশাটা একটু বেশীই। সূর্যের আলো তাই ছড়িয়ে পরতে পারেনি চারদিকে।
এমন সকালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগে। খুব জরুরি কোনো প্রয়োজন না থাকলে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করেনা। আলীর ইচ্ছা করছিলো শুয়ে থাকতে অন্ততঃ আরো ঘন্টা খানেক। কিন্তু গরীবের জন্য এ আরাম যে হারাম, তা সে তার অল্প বয়সের অভিজ্ঞতাতেই বুঝে ফেলেছে। একদিন কাজ না করলে যার পেটে ভাত জোটে না, তার জন্য এ সুখতো সয় না।
আলী ভাবে দিনমজুরের যদি সপ্তাহে এক দিন ছুটি থাকতো, তা কি মজাটাই না হতো। ছয় দিন কাজ, সাত দিনের মজুরী, এক দিন ছুটি। অথচ খাওয়ার কোনো চিন্তা নাই। বাহ্ ! আলী মনে মনে ভাবে এমন একটা ব্যবস্থা যদি তার হতো- তাহলে এই দুনিয়ায় তার মতো সুখী বুঝি আর কেউ হতো না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে তার তন্দ্রা এসেছিল। এসময় আলীর মা উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে “ আলী, অই আলী” জলদি ওঠ বাবা, কামে যা। আইজ ইকটু তাড়াতাড়ি ফিরবি, বৈকালে গঞ্জে যাইবি, কেজি খানিক গুড় আনতে হইবো। কাইল জুম্মায মিলাদ দিমু। তোর কামেও যাওন লাগবো না।”

আলী মায়ের ডাকে ও কথায় ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়। সে কিছুটা খেঁকিয়ে ওঠে, জিজ্ঞেসা করে- ক্যান ? কামে যাওন লগবো না ক্যান? বলেই সে কাঁথা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। আলীর মা চিৎকার করে ওঠে- ক্যান, এই দিনের কতা তোর মনে থাকে না। পত্যেক বছর তরে এই দিনের কতা মনে করাইয়া দেওন লাগবো? নিজের বাপের মরনের দিনের কথা তোর মনে থাকে না ? মনে থাকে না এই দিনে পশ্চিমা মিলিটারি আর রাজাগার মিল্যা তোর তোর বাপরে গুলি কইরা মারছিল। তোর বইনের সেই দশার কতা কি তুই ভুইাল্যা গ্যাছোস? আলীর মার চিৎকার বিলাপে রুপ নেয়, সে আচঁলে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে।

আলী কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়। উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটতে থাকে... ঘাসের উপর শিশিরগুলোর পতন ঘটে। ধীরে ধীরে প্রখর হয়ে ওঠে সূর্যের সোনালি আলো। খোলা মাঠের বুক চিরে পথ। আলী সেই মেঠোপথ ধরে চলতে থাকে ভিন্ন এক জগতের উদ্দেশ্যে। না, না, সে মনে করতে চায় না তার বাবার মৃত্যুদিনের সেই স্মৃতি। তার বোনের ধর্ষিতা হওয়ার বেদনার কথা।

সেইদিন পশ্চিম পাকিস্থানী মিলিটারী আর রাজাকাররা হঠাৎ তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। তারপর তারা আলীর বাবাকে গুলি করে হত্যা করে, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে। মিলিটারীরা চলে যাওয়ার পর কয়েকজন রাজাকার প্রকাশ্যে দিবালোকে তার বোনকে ধর্ষন করে ।
আলীর বুকটা ভেঁঙ্গে খান্ খান্ হয়ে যায়, আবার মহা এক আক্রোশ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে তার হৃদয়।

যদিও আলী তখন ছোট, তবু সে আনেক কিছুই বুঝতে পারতো। রাজাকাররা চলে যাওয়ার পর গ্রামের লোকেরা তার বাবাকে তাড়াতাড়ি কবর দেয়। কেউ কেউ শান্তনার বাণী শুনিয়ে সট্কে পরে।

আলী ভাবে, মুক্তিযুদ্ধ কি? ক্যান তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে গেছিল? মুক্তিযুদ্ধে না গেলে ওরা তো তার বাবাকে খুন করতো না, আর তার বোনের ইজ্জতও যাইতো না। আলী শুধু কাঁদছিলো। লোকজন চলে গেছে। চারদিকে সুনসান । অবসন্ন আলী ঘরের ভেতরে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা তার মায়ের কাছে এসে বসে। ছোট্র বুকটা দুঃখে কষ্টে যেন ফেঁটে যায়। সে তার মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে। কতণ, কতসময় গড়িয়ে চলে যায় সে বুঝতে পারে না। হঠাৎ আবার লোকজনের হট্রগোল । চমকে ওঠে আলী। আবার বুঝি মিলিটারী রাজাকাররা আসতাছে। এবার তার মা-বোন ও তাকেও বুঝি ওরা গুলি করে মারবে।

সে লাফ দিয়ে ঘরের বাইরে আসে। হায় একি ! তার বোনের লাশ ঝুলে আছে পুরোনো আম গাছের ডালে। শরমে গলায় ফাঁস দিছে। আহা বৈইন ! আলীর মনে হয় এসময় যদি তার হাতে একটা বন্দুক থাকতো, সে একাই সব মিলিটারী রাজাকারদের গুলি করে মারতো। আলী আর কাঁদে না যেন বোবা হয়ে যায়।

উৎসুক জনতা বাড়ির বাইরে ভীড় করছিলো। দুই একজন ছাড়া কারোর কাছেই আলী সমবেদনার কথা শুনলো না। অথচ কেউ কেউ ফ্সি ফ্সি করে তার বোনের যৌবন ভারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের রসালো বনর্না দিচ্ছিল। আনেকের চোখে সে দেখছে মাংসাসী জন্তুর ন্যায় লোলুপ দৃষ্টি। তাদের জীবগুলো যেন লক্লক করছিলো জৈবিক সুখ আস্বাদনের নেশায়। এতদিনের চেনা মানুষগুলো যেন হঠাৎ অচেনা প্রাণীতে পরিণত হয় তার কাছে। তখন আলীর অব্যক্ত কণ্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে এক ধ্বনি “শালা তোরা কি মানুষ...না... ভিন্নরুপে ঐ রাজাকার”?

পাখিদের কলরব / নয়ন সরখেল

তুমি কি জান
পাখি কেন ডাকে?
তোমার ঘুম ভাঙাবে বলে।

তুমি কি জান
পাখিরা কেন উড়ে?
শিশুদের আনন্দ দেবে বলে।

পাখিরা সকালে ডাকে
সবার ঘুম ভাঙাবে বলে;
সবাই শোনে পাখিদের কলরব।

এভাবে আমাদের ঘুম ভাঙে
পাখিদের কলরবে

বিষাদ বিষয়ে কথকতা / এস এ পলাশ রায়

জানালা দিয়ে তাকিয়ে আজ কেন মনে হল, শরীর তাঁর পাখির মতোই। চেয়ার ছেড়ে যে কোনো মুহূর্তে যেন তিনি উড়ে যাবেন অনন্তের দিকে চারদিক এলোমেলো করে সহসা ঝাপিয়ে পড়ল বৃষ্টি। ঠান্ডার পুবের আকাশে মেঘের স্তর অনেক নিচুতে। খুব নিচ দিয়ে উড়ে যায় মেঘেরা। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় মেঘের শরীর। বৃষ্টি যেন মুহূর্তেই বদলে দিল পুরো সন্ধ্যার চালচিত্র; বাংলাদেশের মতো।

জ্ঞান চর্চা / নাহিদ হাসান

(২৬ আগস্ট ২০০৬ খ্রিঃ তারিখে ফুলবাড়ী শহীদদের প্রতি)

এই বাচ্চারা, লাইনে দাঁড়াও, সোজা হও এবারে শপৎ -
আমরা শপৎ করিতেছি যে, তিরিশ ল শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
এই বাংলাদেশ রাস্ট্রের প্রতি অনুগত থাকিব এবং জীবনের বিনিময়ে হলেও
জাতীয় পতাকার মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত রা করিব

অ্যাই শোনা, ডু নট কোয়ারল মানে ঝগড়া করো না! পড় -
দাতা সংস্থা ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক প্রভৃতির নামে
কেননা, তারা আমাদের যাবতীয় শিা উপকরণ দান করেছেন
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, বহুজাতিক এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে;
যেখানে তোমাদের পিতারা চাকুরী করেন এবং মায়েদের
সব্জীরচাষ-ঋণগ্রহণ-মোটা তাজাকরণের মাধ্যমে মঙ্গাকে মঙ্গলে পাঠানোর কথা বলা হয়
ধন্যবাদ জানাও মার্কিন দূতাবাসকে; যা মার্কিন স্বর্গ ও দুনিয়ার সংযোগ সেতু
এবং আমাদের সকল ভালো-মন্দের মা-বাপ
আর কাসরুমে বসে যে রাস্তাটি দেখা যায়, যা হাজার হাজার কয়লাবাহী
ট্রাকের ভারে উল্লসিত; সেটিও উন্নয়ন সহযোগী এশিয়া এনার্জি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত,
এতএব তাকেও ধন্যবাদ

বউ প্লাস চ্যানেল / আরাফাত রাতিন

প্রিয়তমা, ফিরে এলে স্বাগতম
স্টার প্লাস দেখে বখে গিয়েছিলে।

নয়টি বছর পেরুলো
বিছানায় তাকিয়ে বল,
তোমার বিছানা কি আমার মতো
পরিপাটি ভাবে থাকে সকালে?

খোকা কি কবিতা বোঝে?
শুনেছি মহিলা সংঘ কর
তোমার মা চাচার বুদ্ধি নেয়
তুমি নেও মারটা
বাবা থাকলে আলাদা হতাম না।

আমি তো শুধু মদ গিলি
অনেকে ঘুষ, নারী, আরও কত কী
যাকগে একটা তথ্য দিই, এখন আর মদ্যপ অবস্থায়
ড্রাইভ-এ ফাইন দিয়ে বেড়াচ্ছি না।

তোমার সংঘে কত মিটিং মিছিল
পথে নয় ফিরে এস
বাড়ির লোডশেডিং উপভোগ কর
মতা-সম্মান সব দেব
বিদ্যুৎ এলে রিমোট দেব।

নয়টি বছর...
ইদানীং খালি মনে হয়
ডিসকভারির বানরগুলো আমায় ভেঙচি কেটে চলেছে।

উপলব্ধি / ইলিয়াড

আমার মতো অচেতন মানুষকে প্রতিবন্ধী বলা যাবে না
আমিও পারি কল্পনা করতে, গবেষণা করতে
পারি অতীতকে স্মরণ করতে

আমি বোধকরি এক প্রকার লুনাটিক