বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১১

ভিন্নরুপী / জুলকার নাইন স্বপন

শীতের সকাল। সবুজ ঘাসের বুকে রসে টইটুম্বুর শিশির বিন্দুগুলো মুক্ত দানার মতো চিক চিক করছে। আজ কুয়াশাটা একটু বেশীই। সূর্যের আলো তাই ছড়িয়ে পরতে পারেনি চারদিকে।
এমন সকালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগে। খুব জরুরি কোনো প্রয়োজন না থাকলে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করেনা। আলীর ইচ্ছা করছিলো শুয়ে থাকতে অন্ততঃ আরো ঘন্টা খানেক। কিন্তু গরীবের জন্য এ আরাম যে হারাম, তা সে তার অল্প বয়সের অভিজ্ঞতাতেই বুঝে ফেলেছে। একদিন কাজ না করলে যার পেটে ভাত জোটে না, তার জন্য এ সুখতো সয় না।
আলী ভাবে দিনমজুরের যদি সপ্তাহে এক দিন ছুটি থাকতো, তা কি মজাটাই না হতো। ছয় দিন কাজ, সাত দিনের মজুরী, এক দিন ছুটি। অথচ খাওয়ার কোনো চিন্তা নাই। বাহ্ ! আলী মনে মনে ভাবে এমন একটা ব্যবস্থা যদি তার হতো- তাহলে এই দুনিয়ায় তার মতো সুখী বুঝি আর কেউ হতো না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে তার তন্দ্রা এসেছিল। এসময় আলীর মা উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে “ আলী, অই আলী” জলদি ওঠ বাবা, কামে যা। আইজ ইকটু তাড়াতাড়ি ফিরবি, বৈকালে গঞ্জে যাইবি, কেজি খানিক গুড় আনতে হইবো। কাইল জুম্মায মিলাদ দিমু। তোর কামেও যাওন লাগবো না।”

আলী মায়ের ডাকে ও কথায় ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়। সে কিছুটা খেঁকিয়ে ওঠে, জিজ্ঞেসা করে- ক্যান ? কামে যাওন লগবো না ক্যান? বলেই সে কাঁথা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। আলীর মা চিৎকার করে ওঠে- ক্যান, এই দিনের কতা তোর মনে থাকে না। পত্যেক বছর তরে এই দিনের কতা মনে করাইয়া দেওন লাগবো? নিজের বাপের মরনের দিনের কথা তোর মনে থাকে না ? মনে থাকে না এই দিনে পশ্চিমা মিলিটারি আর রাজাগার মিল্যা তোর তোর বাপরে গুলি কইরা মারছিল। তোর বইনের সেই দশার কতা কি তুই ভুইাল্যা গ্যাছোস? আলীর মার চিৎকার বিলাপে রুপ নেয়, সে আচঁলে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে।

আলী কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়। উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটতে থাকে... ঘাসের উপর শিশিরগুলোর পতন ঘটে। ধীরে ধীরে প্রখর হয়ে ওঠে সূর্যের সোনালি আলো। খোলা মাঠের বুক চিরে পথ। আলী সেই মেঠোপথ ধরে চলতে থাকে ভিন্ন এক জগতের উদ্দেশ্যে। না, না, সে মনে করতে চায় না তার বাবার মৃত্যুদিনের সেই স্মৃতি। তার বোনের ধর্ষিতা হওয়ার বেদনার কথা।

সেইদিন পশ্চিম পাকিস্থানী মিলিটারী আর রাজাকাররা হঠাৎ তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। তারপর তারা আলীর বাবাকে গুলি করে হত্যা করে, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে। মিলিটারীরা চলে যাওয়ার পর কয়েকজন রাজাকার প্রকাশ্যে দিবালোকে তার বোনকে ধর্ষন করে ।
আলীর বুকটা ভেঁঙ্গে খান্ খান্ হয়ে যায়, আবার মহা এক আক্রোশ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে তার হৃদয়।

যদিও আলী তখন ছোট, তবু সে আনেক কিছুই বুঝতে পারতো। রাজাকাররা চলে যাওয়ার পর গ্রামের লোকেরা তার বাবাকে তাড়াতাড়ি কবর দেয়। কেউ কেউ শান্তনার বাণী শুনিয়ে সট্কে পরে।

আলী ভাবে, মুক্তিযুদ্ধ কি? ক্যান তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে গেছিল? মুক্তিযুদ্ধে না গেলে ওরা তো তার বাবাকে খুন করতো না, আর তার বোনের ইজ্জতও যাইতো না। আলী শুধু কাঁদছিলো। লোকজন চলে গেছে। চারদিকে সুনসান । অবসন্ন আলী ঘরের ভেতরে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা তার মায়ের কাছে এসে বসে। ছোট্র বুকটা দুঃখে কষ্টে যেন ফেঁটে যায়। সে তার মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে। কতণ, কতসময় গড়িয়ে চলে যায় সে বুঝতে পারে না। হঠাৎ আবার লোকজনের হট্রগোল । চমকে ওঠে আলী। আবার বুঝি মিলিটারী রাজাকাররা আসতাছে। এবার তার মা-বোন ও তাকেও বুঝি ওরা গুলি করে মারবে।

সে লাফ দিয়ে ঘরের বাইরে আসে। হায় একি ! তার বোনের লাশ ঝুলে আছে পুরোনো আম গাছের ডালে। শরমে গলায় ফাঁস দিছে। আহা বৈইন ! আলীর মনে হয় এসময় যদি তার হাতে একটা বন্দুক থাকতো, সে একাই সব মিলিটারী রাজাকারদের গুলি করে মারতো। আলী আর কাঁদে না যেন বোবা হয়ে যায়।

উৎসুক জনতা বাড়ির বাইরে ভীড় করছিলো। দুই একজন ছাড়া কারোর কাছেই আলী সমবেদনার কথা শুনলো না। অথচ কেউ কেউ ফ্সি ফ্সি করে তার বোনের যৌবন ভারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের রসালো বনর্না দিচ্ছিল। আনেকের চোখে সে দেখছে মাংসাসী জন্তুর ন্যায় লোলুপ দৃষ্টি। তাদের জীবগুলো যেন লক্লক করছিলো জৈবিক সুখ আস্বাদনের নেশায়। এতদিনের চেনা মানুষগুলো যেন হঠাৎ অচেনা প্রাণীতে পরিণত হয় তার কাছে। তখন আলীর অব্যক্ত কণ্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে এক ধ্বনি “শালা তোরা কি মানুষ...না... ভিন্নরুপে ঐ রাজাকার”?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন